সমুদ্র আইন ট্রাইব্যুনালের আদ্যোপান্ত

হামবুর্গে অবস্থিত ট্রাইব্যুনালইউনাইটেট ন্যাশনস কনভেনশন অন দ্য ল’ অফ দ্য সির (আনক্লজ) অধীনে একটি স্বাধীন বিচারিক আদালত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় দ্য ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল’ অফ দ্য সি। উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই কনভেনশনের ব্যাখ্যা এবং প্রয়োগ সম্পর্কিত বিরোধ মীমাংসা। একুশ জন স্বাধীন সদস্য নিয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠিত, যারা সমুদ্র আইন বিষয়ে একাগ্রতা ও স্বচ্ছতার জন্য সুনাম অর্জন করেছেন এবং আইনি যোগ্যতার কারণে স্বীকৃত হয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালের প্রথম বিচারক নির্বাচিত হন ১৯৯৬ সালের ১ আগস্ট। একই বছরের ১ অক্টোবর জার্মানির হামবুর্গে ট্রাইব্যুনাল কাজ শুরু করে।
সমুদ্র আইনবিষয়ক জাতিসংঘের তৃতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলো ১৯৮১ সালের ২১ আগস্ট গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের জন্য হামবুর্গকে বেছে নেন। আন্তর্জাতিক শিপিং এবং সামুদ্রিক বাণিজ্যে সুনাম থাকার কারণে জার্মানির এই বন্দর শহরকে পছন্দ করা হয়।
ট্রাইব্যুনালের দাপ্তরিক ভাষা হচ্ছে ইংবেজি এবং ফেঞ্চ। বিচার চলাকালে পক্ষগুলো অন্যান্য ভাষাও ব্যবহার করতে পারে, তবে সে ক্ষেত্রে অন্য ভাষা ব্যবহারকারী পক্ষকে ব্যাখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় আয়োজন অথবা যেকোনো দাপ্তরিক ভাষায় তরজমার জন্য অনুরোধ করা হয়।
একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে ট্রাইব্যুনাল জাতিসংঘের সাথে সহযোগিতা এবং সম্পর্কের ব্যাপারে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ট্রাইব্যুনালকে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন, ভাতা ও সুবিধাদি সংক্রান্ত জাতিসংঘের সাধারণ ব্যবস্থা অনুযায়ী পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন।
২০১১-১২ সেশনের জন্য ট্রাইব্যুনালের বাজেট ধার্য করা হয়েছে ২০,৩৯৮,৬০০ ইউরো।
আনক্লজের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১৬২। এর মধ্যে ১৬১টি রাষ্ট্র। অন্য সদস্য একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা-ইউরোপীয়ান কমিউনিটি।

বিচারক
২১ জন বিচারকের সমন্বয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন তারা। পক্ষরাষ্ট্রগুলো বিচারকদের মনোনয়ন দেবে এবং তাদের দুইতৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন হবে। তিন বছর পর পর সদস্য রাষ্ট্রগুলো নিউইয়র্কে তাদের বৈঠকে একতৃতীয়াংশ বিচারক নির্বাচন করেন। একজন নির্বাচিত বিচারকের মেয়াদ নয় বছর। একই জাতীয়তার একাধিক বিচারক ট্রাইব্যুনালে থাকেন না। এছাড়াও ভৌগোলিক অঞ্চলগত সংখ্যা নির্ধারিত আছে। আফ্রিকা থেকে ৫, এশিয়া থেকে ৫, পূর্ব ইউরোপ থেকে ৩, ল্যাটিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান থেকে ৪, পশ্চিম ইউরোপ এবং অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো থেকে ৪ জন বিচারক নির্বাচন করা হয়।
নির্বাচিত বিচারকদের ভোটে আবার তিন বছর মেয়াদের জন্য সভাপতি এবং সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।

এডহক বিচারক : বেঞ্চে বিরোধের কোনো পক্ষের যদি নিজের দেশের বিচারক না থাকে তবে সেই পক্ষ মামলাচলাকালীন সময়ে একজন ব্যক্তিকে বিচারক হিসেবে মনোনয়ন দিতে পারে। এডহক বিচারক অন্যান্য বিচারকদের সঙ্গে একই মর্যাদায় বিচারে অংশগ্রহণ করেন। ট্রাইব্যুনালের ষোলতম মামলা বাংলাদেশ-মিয়ানমার মামলায় এডহক বিচারক হিসেবে বাংলাদেশ ঘানার থমাস মেনসাহকে আর মিয়ানমার পছন্দ করেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের বেমার্ড এইচ অক্সম্যানকে। এর আগে ট্রাইব্যুনালের ১২তম মামলায় বাংলাদেশের ড. কামাল হোসেনকে মালয়েশিয়া আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের বেমার্ড এইচ অক্সম্যানকে সিঙ্গাপুর এডহক বিচারক হিসেবে পছন্দ করেছিল।

এখতিয়ার
আনক্লজের অধীনে ট্রাইব্যুনালে দাখিলকৃত সব ধরনের বিরোধ নিষ্পত্তির এখতিয়ার রয়েছে ট্রাইব্যুনালের। ট্রাইব্যুনালের সংবিধির ২১ অনুচ্ছেদ মতে, অন্য যে কোনো চুক্তির মাধ্যমে বিশেষভাবে যদি এই ট্রাইব্যুনালের ওপর এখতিয়ার আরোপ করা হয়, তবে সেসব বিষয় নিষ্পত্তি করার এখতিয়ার থাকবে ট্রাইব্যুনালের। ট্রাইব্যুনালের দুই ধরনের এখতিয়ার রয়েছে। ধারাবাহিক এখতিয়ার এবং উপদেশমূলক এখতিয়ার (এডভাইজরি জুরিসডিকশন)।
আনক্লজের যে কোনো ধরনের ব্যাখ্যা বা প্রয়োগ সংক্রান্ত বিষয় ট্রাইব্যুনাল সমাধা করতে পারে এর ধারাবাহিক এখতিয়ারের অধীনে। আর ইন্টারন্যাশনাল সিবেড অথোরিটি’র যে কোনো ধরনের কর্মকা- থেকে আইনি প্রশ্নের জন্ম হলে সেখানে ট্রাইব্যুনালের সিবেড বিরোধ সংক্রান্ত চেম্বার উপদেশমূলক এখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারে।
সদস্য রাষ্ট্র ছাড়াও কনভেনশনের একাদশ অধ্যায়ের অধীনে অন্যান্য সত্তার জন্যও ট্রাইব্যুনালে বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ রয়েছে। তবে বিরোধের সব পক্ষগুলো চুক্তির মাধ্যমে একমত হতে হবে।
মামলা
১৩ নভেম্বর ১৯৯৭ সালে ট্রাইব্যুনালে প্রথম মামলা হয়। মামলাটি ছিল সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড দ্য গ্রানাডিনস বনাম গায়ানা। বর্তমান সময় পর্যন্ত মামলা হয়েছে ১৯টি। সর্বশেষ ১৯ নাম্বার মামলা ভার্জিনিয়া জি (পানামা বনাম গিনি বিসাউ) মামলা। আর সর্বশেষ মীমাংসিত মামলা বাংলাদেশ-মিয়ানমার।